কি যেন লিখবো?


 

লেখালেখি একটি সৃজনশীল কর্ম। এটি কেবল শব্দের সমাহার নয়, বরং চিন্তার রঙে রাঙানো এক গভীর শিল্প, যার মাধ্যমে লেখক পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি স্পর্শ করেন। কিন্তু এমন এক সময় আসে যখন সেই অনন্ত শব্দের ভাণ্ডার হঠাৎ করেই যেন ফুরিয়ে যায়। কলম নড়ে না, কাগজ নীরব থাকে, মাথার মধ্যে শুধু শূন্যতা। এই অবস্থার নামই ‘রাইটার্স ব্লক’ বা লেখকের বন্ধ্যাত্ব। লেখকের বন্ধ্যাত্ব একেবারে নতুন কিছু নয়। প্রাচীন সাহিত্যিক থেকে শুরু করে আধুনিক চিত্রনাট্যকার—প্রায় সবাই কোনও না কোনও পর্যায়ে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। কেউ এক সপ্তাহ, কেউ এক মাস, আবার কেউ কখনও পুরো বছর পার করে ফেলেছেন একটি শব্দ না লিখেই।


রাইটার্স ব্লক কী?

রাইটার্স ব্লক হলো সেই মানসিক অবস্থা, যখন একজন লেখক তার চিন্তা প্রকাশ করতে অক্ষম হন। তার মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে যায়—শব্দেরা আর তাকে সঙ্গ দিতে চায় না। কল্পনার জগৎ হয়ে ওঠে নিঃশব্দ। কলম যেন বিদ্রোহ করে, কাগজ যেন মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটি শুধুমাত্র অনুপ্রেরণার অভাব নয়, বরং আরও জটিল ও বহুমাত্রিক একটি সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অতিরিক্ত চাপ, নিখুঁত হওয়ার ভয় কিংবা পারিপার্শ্বিক নানা সমস্যা।


কেন ঘটে এই বন্ধ্যাত্ব?

রাইটার্স ব্লক নানা কারণে হতে পারে। যেমন:

১. অতিরিক্ত প্রত্যাশা: অনেক সময় লেখক নিজেই নিজের উপর এতটা প্রত্যাশার চাপ সৃষ্টি করেন যে তা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট করে দেয়।

২. ভয়: ‘লেখাটা ঠিক হবে তো?’—এই প্রশ্ন লেখার আগেই ভয় ধরিয়ে দেয়। ফলাফল—লেখা শুরুই হয় না।

৩. পরিবেশগত অনুপ্রেরণার অভাব: চারপাশের একঘেয়ে পরিবেশ, ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতা কিংবা কাজের চাপও রাইটার্স ব্লকের কারণ হতে পারে।

৪. নেগেটিভ ফিডব্যাক: অতীতের কোনো লেখায় নেতিবাচক মন্তব্য শুনে লেখকের আত্মবিশ্বাস ভেঙে যেতে পারে।

৫. মানসিক চাপ বা ক্লান্তি: অবসাদ বা উদ্বেগও লেখার ইচ্ছাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

বিশ্বের বহু নামকরা লেখক এই বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত হয়েছেন। এর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, "There is nothing to writing. All you do is sit down at a typewriter and bleed."—এই 'bleeding'-এর অর্থই হচ্ছে নিজের ভেতরের জগৎ উন্মোচন করা, যা অনেক সময় আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।


কলমের নীরবতা: লেখকের এক কঠিন সময়

 তবে প্রশ্ন আসতে পরে, এই রোগের চিকিৎসা কি নেই।  হ্যাঁ আছে! এই রোগের চিকিৎসাও আছে। রাইটার্স ব্লক চিরস্থায়ী নয়। এটি একটি অস্থায়ী অবস্থা, যার নিরাময় সম্ভব।  জে.কে. রাওলিং ও স্টিফেন কিং-এর মতো লেখকরাও এমন সময় পার করেছেন, যখন তারা ভেবেছেন তারা আর কখনওই লিখতে পারবেন না। কিন্তু সেই সব লেখকেরাও তাদের নিজস্ব কিছু  উপায়ে এই বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের সেই মুক্তি পাওয়ার কিছু কার্যকর পন্থা নিচে তুলে ধরা হলো—

১. লেখার অভ্যাস বজায় রাখুন: লেখা আসুক বা না আসুক, প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করুন। জার্নাল লেখা, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা, ছোট ছোট বাক্যে মনের ভাব প্রকাশ করাও একটি কার্যকর অনুশীলন।

২. আন্তরিক লেখা, নিখুঁত নয়: প্রথম খসড়া নিখুঁত হবে না এই সত্যটি মেনে নিতে হবে। নিজের উপর নিখুঁত লেখার চাপ কমালে লেখা অনেক সহজ হয়।

৩. পাঠক না, লেখক হয়ে উঠুন: অনেক সময় আমরা পাঠকের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে লিখি না। সেই ভয় কাটিয়ে লেখক হিসেবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করাই লেখার প্রকৃত আনন্দ।

৪. পঠনের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা খোঁজুন: ভালো বই পড়া, প্রিয় লেখকদের লেখা পাঠ করা বা এমনকি কবিতা পড়াও আপনাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বহু লেখকই নতুন অনুপ্রেরণার খোঁজে পড়ার ভুবনে ডুবে যান।

৫. চলাফেরা ও প্রকৃতির সাহচর্য: প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছু সময় কাটানো, হাঁটা বা ভ্রমণ এসব শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনাকে সতেজ করে তুলতে পারে। অনেক সময় পাহাড়, নদী বা গোধূলির আকাশ নতুন ভাবনার জন্ম দেয়।

৬. নতুন বিষয়ে ভাবুন: সব সময় একই বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করলে তা একঘেয়ে হয়ে যায়। নতুন কোনো বিষয় বেছে নিন। অচেনা পথে হাঁটলে অনেক সময় নতুন শব্দেরা কাছে আসে।

৭. নিজের লেখা পুনরায় পড়ুন: পুরোনো লেখা পড়ে দেখুন। সেখান থেকে হয়তো নতুন কিছু অনুপ্রেরণা পাবেন, কিংবা কিছু সংযোজনের মধ্য দিয়ে পুনরায় লেখার ধারা খুঁজে পাবেন।

৮. একটু বিরতি নিন: চাপ দিলে লেখা হয় না। মাঝে মাঝে লেখা থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজের মনকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। এই বিশ্রামের মধ্যেই অনেক সময় চিন্তার জন্ম হয়।


সর্বপুরি, রাইটার্স ব্লক কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং এটি লেখকের সৃষ্টিশীল যাত্রারই একটি অংশ। এটি এমন একটি অধ্যায়, যা আপনাকে ভেতর থেকে নতুন করে গড়ে তোলে। একে অতিক্রম করতে পারলেই আপনি নিজের ভাবনার জগতকে নতুনভাবে চিনতে পারবেন।

তাই, যখনই আপনার কলম চলতে চায় না, মনে রাখবেন—আপনি একা নন। অগণিত মহান লেখকও এই যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গেছেন। এবং তারাও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আপনি পারবেন, কারণ শব্দেরা একদিন ফিরে আসেই—নীরবতার মধ্য দিয়েই তারা ফেরার পথ খোঁজে।

আপনার জাদু হারায়নি—শুধু একটু বিশ্রামে গেছে। আপনার কলম আবার গর্জে উঠবে, নদী আবার বয়, মেঘেরা আবার ছুটবে, হাওয়া আবার কানে কানে গল্প বলবে।



✍️সফিউল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.