স্বপ্ন না থাকলে সংগ্রাম অর্থহীন

 


জীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই মানুষ কিছু না কিছু চায়, কিছু না কিছু পাওয়ার আশায় ছুটে চলে দিনরাত। কখনো ক্লান্তি আসে, কখনো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তবুও থেমে যায় না। এই যে এগিয়ে চলা, এই যে অবিরাম সংগ্রাম—তা কেন? কী আছে এর পেছনে? একটিই উত্তর—স্বপ্ন। যে মানুষ স্বপ্ন দেখে না, তার পক্ষে এই পথ চলা সম্ভব নয়। স্বপ্নহীন মানুষ কেবল শ্বাস নেয়, কিন্তু বাঁচে না। সে শুধুই সময় পার করে, জীবনের আসল সৌন্দর্য আর গভীরতা তার কাছে অধরা থেকে যায়। একটি শিশু যখন প্রথম হাঁটতে শেখে, তখন সে পড়ে যায় বারবার। তবুও সে থেমে থাকে না। কারণ তার মনে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে—সে হাঁটবে, বড়দের মতো চলবে। এই আকাঙ্ক্ষাই তার প্রথম স্বপ্ন। জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ স্বপ্ন দেখতে শেখে, যদিও তখন তা সে নিজে বুঝে না। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, মানুষ বুঝে স্বপ্ন কী, আর কেমন করে সেই স্বপ্ন মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। স্বপ্ন আসলে একধরনের ভিতরের আলো, যা অন্ধকার সময়েও দিকনির্দেশনা দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা বড় হয়ে উঠেছে, যারা নতুন কিছু সৃষ্টি করেছে, যারা সমাজ বা জাতিকে বদলে দিয়েছে—তারা সবাই স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের অনেকের পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ, দারিদ্র্য, অপমান, ব্যর্থতা কিছুই তাদের জীবন থেকে বাদ যায়নি। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি, কারণ তাদের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নই তাদের রাত জাগিয়েছে, দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করার শক্তি দিয়েছে, শত বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে। অন্যদিকে যদি কোনো মানুষ জীবনে কোনো লক্ষ্য স্থির না করে, কোনো স্বপ্ন না দেখে, তাহলে তার পরিশ্রম কেবল একঘেয়ে একটা দায়িত্ব পালন হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে থাকে না আত্মতৃপ্তি, থাকে না আনন্দ। একজন কৃষক যখন ভোরবেলা উঠে জমিতে কাজ করতে যায়, তার চোখে একটা স্বপ্ন থাকে—ফসল ফলবে, পরিবার খাবে, বাজারে বিক্রি হবে, ঋণ শোধ হবে, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ উঠবে। এই স্বপ্নই তাকে রোদে-ঘামে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। যদি সে জানতোই না কেন সে এত কষ্ট করছে, তাহলে হয়তো একদিনও মাঠে যেত না। আবার একজন শিল্পী দিনরাত আঁকে, কখনো সে অর্থ পায়, কখনো প্রশংসা; কখনো কিছুই না। তবুও সে থামে না। কারণ তার মনে একটা ছবি আছে, একটা অভ্যন্তরীণ তাগিদ আছে—সে কিছু সৃষ্টি করতে চায়। সেই চাওয়াটাই তার স্বপ্ন। তাকে আঁকতে শেখায়, ভুল শোধরাতে শেখায়, আবার নতুন করে শুরু করতে শেখায়। মানুষের জীবন অনেকটা সমুদ্র যাত্রার মতো। সেখানে ঢেউ আছে, ঝড় আছে, ভাটার টান আছে। কিন্তু যদি নাবিকের চোখে থাকে দিগন্তে দেখা একটি তটরেখা—একটি স্বপ্ন—তবে সে জানে সে কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে। আর যদি না থাকে কোনো তীরের ঠিকানা, তবে সে কেবল ভাসতে থাকবে, কোথাও পৌঁছাতে পারবে না। এই দিক হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোই সমাজে হাজারো আছে, যারা জীবনের গভীরতা বোঝে না, শুধু দৈনন্দিনতার চক্রে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সময় সমাজ বা পরিবার স্বপ্ন দেখতে নিরুৎসাহিত করে। বলে—স্বপ্ন দেখে কী হবে, বাস্তবতা তো কঠিন। কিন্তু মানুষ যদি স্বপ্ন না দেখে, তবে সেই কঠিন বাস্তবতা পরিবর্তনের সাহস কোথা থেকে আসবে? যে মানুষ স্বপ্ন দেখে না, সে নিজের জীবনকেই পরিবর্তন করতে পারে না, সমাজ বা জাতিকে বদলানো তো দূরের কথা।স্বপ্ন কখনো সহজে বাস্তব হয় না। তার পেছনে লাগে পরিশ্রম, সময়, আত্মত্যাগ। অনেক সময় স্বপ্ন ভেঙে পড়ে, অনেক সময় মনে হয়—সব চেষ্টাই বৃথা। কিন্তু এখানেই আসে সংগ্রামের জায়গা। স্বপ্ন মানুষকে সংগ্রামী করে তোলে। আর সংগ্রাম তখনই সার্থক হয়, যখন তার পেছনে কোনো অর্থ থাকে। সেই অর্থই আসে স্বপ্ন থেকে। সংগ্রাম যেন একটা সেতু, যা মানুষকে স্বপ্ন থেকে সফলতার দিকে নিয়ে যায়। সেতুর দুই প্রান্তে যদি কিছু না থাকে, তবে সে সেতু বানানোই বৃথা। স্বপ্নহীন জীবন আসলে একটা যান্ত্রিকতা। সেখানে সকালে উঠে কাজ, রাতে ঘুম, সপ্তাহ শেষে বিশ্রাম—এই চক্রে জীবনের সৌন্দর্য বা মানে হারিয়ে যায়। মানুষ তখন কেবল বেঁচে থাকে, কিন্তু প্রাণে বাঁচে না। অথচ একটা স্বপ্ন থাকলে সেই প্রতিদিনকার কাজও হয়ে ওঠে আনন্দময়, তা যত কষ্টকর হোক না কেন। আজকের এই দ্রুতগতির দুনিয়ায় সবাই ছুটছে, সবাই ব্যস্ত। কিন্তু কেউ কেউ ছুটছে স্বপ্নপূরণের দিকে, আর কেউ ছুটছে কেবল সময় পার করার জন্য। এই দুই ধরনের জীবনের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় সেই ছোট্ট কিন্তু মহৎ জিনিস—স্বপ্ন। স্বপ্ন না থাকলে সংগ্রাম হবে কেবলই কষ্ট, আর যদি স্বপ্ন থাকে, তবে সংগ্রাম হয়ে ওঠে সাধনা। এই জন্যই বলা যায়, স্বপ্ন ছাড়া সংগ্রাম অর্থহীন। যে জীবনে স্বপ্ন নেই, সে জীবন লক্ষ্যহীন নৌকার মতো, যে কেবল ভাসে কিন্তু কোথাও পৌঁছায় না। মানুষের জীবনে স্বপ্ন থাকা মানেই তার সংগ্রাম সার্থক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই সম্ভাবনাই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।


✍️সফিউল ইসলাম 


No comments

Powered by Blogger.