রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কোন পথে?

 


বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকটগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট অন্যতম গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চালানো বর্বর অভিযানের ফলে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ইতোমধ্যে এই সংখ্যা প্রায় দশ লাখে পৌঁছেছে, যা কক্সবাজারের মতো একটি ছোট এলাকার জন্য এক বিশাল মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কথা বলে আসছে। তবে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। বরং রাখাইনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, যা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সংকটের সমাধান কীভাবে সম্ভব? রোহিঙ্গারা কি নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আশা করতে পারে, নাকি তারা আরও দীর্ঘ সময় ধরে শরণার্থী হিসেবেই বেঁচে থাকবে? রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। তবে মিয়ানমার সরকার তাদের কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রহীন করে ফেলে, ফলে তারা মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এরপর থেকে এই জনগোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে বৈষম্য, নির্যাতন এবং সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালায়, তা ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়। হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এবং গণবিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়ে লাখো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই বর্বরতার কারণে আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করেছে। তবে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ২০১৭ সালের শেষের দিকে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে বলা হয় রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় এবং নিরাপদে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দু’দফা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো রোহিঙ্গাই রাখাইনে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। এর কয়েকটি প্রধান কারণ ছিল— মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেনি। রাখাইনে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি, বরং সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন অব্যাহত ছিল। ফেরত গেলে রোহিঙ্গারা যেখানে বাস করত, সেসব গ্রাম পুনর্গঠন করা হয়নি। বরং সেনাবাহিনী সেখানে সামরিক স্থাপনা তৈরি করেছে। রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফেরত গেলে তারা বন্দিশিবিরের মতো জায়গায় বসবাস করতে বাধ্য হবে বলে আশঙ্কা করে। এই পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মত দিয়েছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে। বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হচ্ছে, যার মধ্যে রাখাইনও অন্তর্ভুক্ত। এই অস্থিরতার কারণে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আরও কমে গেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাদের বৈষম্যমূলক নীতি পরিবর্তন করেনি। বরং তারা রোহিঙ্গাদের আরও কোণঠাসা করে রাখার পরিকল্পনা করছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও তা তাদের অবস্থান পরিবর্তনে কার্যকর প্রভাব ফেলেনি। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নেই।  

বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে এত বড় শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে সামলানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থীদের জন্য বিশাল পরিমাণ তহবিল প্রয়োজন, যা ক্রমশ কমছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বনভূমি কেটে বসতি নির্মাণ করায় কক্সবাজারের পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবপাচার, মাদক ব্যবসা এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় জনগণ মনে করে রোহিঙ্গারা তাদের জন্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে, ফলে সামাজিক উত্তেজনা বাড়ছে।  

বাংলাদেশ সরকার সমাধান হিসেবে কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে, তবে এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। তবে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিত্র হওয়ায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোনো কার্যকর প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে, ওআইসি (ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা) রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বললেও মিয়ানমারের ওপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। গত ১৩ মার্চ ( বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ সফরে এসেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। পরে গত শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শনের সময় তিনি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নেন, সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি তার বক্তব্যে বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একমাত্র সমাধান তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন"। তবে এই দিক বিবেচনা করা গেলেও অসংখ্য থেকে যায় কতটা নিরাপদ তাদের প্রত্যাবাসন।কী হতে পারে? রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ। নিরাপদ প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদের জন্য আদর্শ সমাধান হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ফেরত পাঠানো হলে তারা নতুন করে নির্যাতনের শিকার হতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে তাদের থাকা অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করছে।  

এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় হয়ে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ ও টেকসই সমাধান বের হয়। অন্যথায়, এই সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যাবে এবং রোহিঙ্গারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে।

✍️ সফিউল ইসলাম 


No comments

Powered by Blogger.