ধর্ষণের মহামারি: আইনের ব্যর্থতা নাকি রাষ্ট্রের দায়?

 


বাংলাদেশে ধর্ষণ যেন এক অপ্রতিরোধ্য মহামারিতে রূপ নিয়েছে। নারীরা ঘরে-বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গণপরিবহনে, কর্মস্থলে কোথাও নিরাপদ নন। প্রতিদিনের খবরের শিরোনাম হয়ে উঠছে লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের অকার্যকারিতা, আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে এই সহিংসতা যেন থামছেই না। ২০১৭ সালের আগস্টের এক রাত। ঢাকা আইডিয়াল ল কলেজের ছাত্রী রুপা চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। বাসের কর্মীদের পাশবিকতার শিকার হয়ে তার নিথর দেহ পড়ে থাকে টাঙ্গাইলের শালবনে। ২০১৯ সালের মে মাসে ইবনে সিনা হাসপাতালের নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়াকে নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জে ফেরার পথে বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। ২০১৫ সালে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে এক গারো তরুণীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করা হয়। এই ছাড়াও দেখা মিলে পত্রিকার সহ সৌশাল মিডিয়া গত দুই একদিন আগের ঘটনা ৮ বছরের ছোট্ট শিশু আসিয়ার ধর্ষণের। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে, কিন্তু প্রতিরোধের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি নৈশকোচে ডাকাতি ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তাকওয়া পরিবহনের বাসে এক দম্পতির ওপর নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়। স্বামীকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। এমন ঘটনার পরও অপরাধীরা ধরা পড়ে না, শাস্তি পায় না। ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় ৯৪% নারী গণপরিবহন কিংবা উন্মুক্ত স্থানে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু গণপরিবহনেই ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৩৪টি।  

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৫৪৬ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, হত্যা করা হয়েছে ২৭ জনকে। ২০১৮ সালে ৭৩২টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হলেও ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৬২৭টিতে, যা ১২২% বৃদ্ধি। ২০২১ সালেও ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি।  

এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, নারীদের জন্য বাংলাদেশ ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। আইন থাকার পরও অপরাধীরা কীভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে? ২০২০ সালের অক্টোবরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পর দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর পরপরই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন এনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়।  

অনেকেই ভেবেছিলেন, কঠোর আইন ধর্ষণের হার কমিয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ২০২০ সালে আইনের পরিবর্তন আসার পরও ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। মূল সমস্যা বিচারহীনতা। অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, ফলে অপরাধ বাড়ছে। 

আইন যদি শুধুই কাগজে-কলমে থেকে যায়, তবে তার কোনো মূল্য নেই। কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও যদি তা প্রয়োগ না হয়, তবে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করছে, দেশে আইন আছে, কিন্তু তা কার্যকর নেই। একটি স্বাধীন দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন এটি লজ্জার এবং রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়।  


দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে উন্নয়ন অর্ধেক থমকে যাবে। নারীদের প্রতিনিয়ত ভয় নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। তারা যখন বাসে উঠেন, রাস্তায় হাঁটেন, অফিসে যান তারা জানেন না, নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন কি না। এটি কি স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল? ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হলেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বদলায়নি। অপরাধীরা জানে, তারা পার পেয়ে যাবে। কারণ মামলার দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তের গাফিলতি, আইনের অপপ্রয়োগ, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ—এসব কারণে দোষীরা শাস্তি পায় না।  


আমরা শুধু কঠোর আইন চাই না, চাই তার যথাযথ বাস্তবায়ন। চাই প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ধর্ষণের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি ঘটনায় দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। 

No comments

Powered by Blogger.